প্রশ্ন
আমি একজন প্রেক্টিসিং মুসলিমাহ। আমি নামায পড়ার কারণে বাসায় আমার আম্মু আমাকে খুব গালাগালি করেন। আমি গিবত করা এবং গালি দেওয়াকে প্রচন্ড রকমের ঘৃণা করি। উনি আমাকে খুব বদ দোয়া করেন (মুখের উপর যা তা বলে ফেলেন)। যদিও মন থেকে আম্মু এটা করে না। কিন্তু আমার অনেক ভয় লাগে, আম্মুর বদ দোয়া নিতে চাই না। সাথে আম্মুকে জাহান্নামের দিকে অগ্রসর হতে দেখতেও চাই না। অনেক দোয়া করি, মাঝে মাঝে রাগ চলে আসে, চিল্লাই ফেলি। আমি এইবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিবো ইংশাআল্লাহ। একজন দ্বীনদার পাত্র বিয়ে করার জন্যে আল্লহর কাছে দোয়া করি, কিন্তু উনার বদ দোয়াতে না জানি আমার সাথে কী হয়? আমি অন্যায় দেখে সহ্য করতে পারি না। এখন আমার কী করা উচিত?
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
حامدا و مصليا و مسلما
মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করা, মায়ের আনুগত্য করা ওয়াজিব। ইসলাম জানিয়েছে, মায়ের পদতলে সন্তানের জান্নাত। মায়ের অবাধ্য হওয়া, মাকে রাগান্বিত করা হারাম; এমনকি সেটা যদি শুধু উফ্ উফ্ শব্দ উচ্চারণ করার মাধ্যমে হয় তবুও। কোরআন-হাদিসের অসংখ্য স্থানে এ বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহর বাণী:
وَقَضَى رَبُّكَ أَلا تَعْبُدُوا إِلا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاهُمَا فَلا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلا كَرِيمًا وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
“তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে `উফ্’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বল। আর মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল ‘হে আমার রব! তাঁদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন’।” (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ২৩-২৪)
এ ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক দলিল ; এ পরিসরে সবগুলো উল্লেখ করা সম্ভব নয়। শুধু এটা মনে রাখবেন, পিতামাতার সেবা ও সদ্ব্যবহারের জন্য তাঁদের মুসলমানও হওয়া জরুরী নয়। মহান আল্লাহ বলেন,
وَإِن جَاهَدَاكَ عَلى أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا
‘‘পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে।” (সূরা লুকমান, আয়াত:১৫)
সুতরাং এক্ষেত্রে আপনার করণীয় হলো,
১. মায়ের সঙ্গে অসদাচারণ না করে ধৈর্য ধারণ করবেন। বেশি বেশি করে আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন, যেন আপনার মায়ের মন-মানসিকতার পরিবর্তন হয়।
২. মা যদি অন্যায় আদেশ করেন (যেমন, গুনাহর আদেশ করেন কিংবা ফরজ-ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ ইবাদতে বাঁধা দেন) কিংবা অন্যায়ভাবে রাগ করেন তাহলে হেকমতের সঙ্গে তাঁর অন্যায় আদেশ এড়িয়ে চলবেন এবং তাঁকে সাথে সাথে নয়; বরং পরবর্তীতে মমতার সঙ্গে ইসলামের এই মূলনীতি বুঝিয়ে বলবেন যে, ইসলামের শিক্ষা হল, لا طاعة لمخلوق في معصية الخالق অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতা যেখানে আসবে, সেখানে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না। কেননা, সৃষ্টির আনুগত্যের সীমারেখা বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূল (সা.) বলেন,
فَإِنْ أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ، فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ
অর্থাৎ অসৎকাজে আনুগত্য নয় ;আনুগত্য কেবলমাত্র সৎকাজের ক্ষেত্রেই হতে হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭১৪৫)
৩. আপনার প্রতি আপনার মায়ের রাগ করা, গালাগালি করা ও বদদোয়া দেয়ার অন্যতম কারণ হল, দীন সম্পর্কে অজ্ঞতা ও দীনের প্রতি মহব্বতের ঘাটতি। এজন্য আপনি মমতাপূর্ণ নসিহতের মাধ্যমে অব্যাহত চেষ্টা ও দোয়া চালিয়ে যান, দেখবেন, একদিন আপনি সফল হবেন এবং তাঁর এই অপূর্ণতা দূরীভূত হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে আপনি কোন হক্কানি আলেমের ওয়াজ বা লেখনী তাঁকে শোনাতে পারেন। ইনশাআল্লাহ এর সুফল অবশ্যই পাবেন।
৪. আমাদের নবীজী (সা.) তো বলেছেন, আপন সন্তান তো দূরের কথা; এমন কি জীবজন্তু ও জড়পদার্থকেও বদদোয়া দেয়া যাবে না। তিনি বলেন,
ﻻَ ﺗَﺪْﻋُﻮﺍ ﻋَﻠَﻰ ﺃَﻧْﻔُﺴِﻜُﻢْ ﻭَﻻَ ﺗَﺪْﻋُﻮﺍ ﻋَﻠَﻰ ﺃَﻭْﻻَﺩِﻛُﻢْ ﻭَﻻَ ﺗَﺪْﻋُﻮﺍ ﻋَﻠَﻰ ﺃَﻣْﻮَﺍﻟِﻜُﻢْ ﻻَ ﺗُﻮَﺍﻓِﻘُﻮﺍ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺳَﺎﻋَﺔً ﻳُﺴْﺄَﻝُ ﻓِﻴﻬَﺎ ﻋَﻄَﺎﺀٌ ﻓَﻴَﺴْﺘَﺠِﻴﺐُ ﻟَﻜُﻢْ
”তোমরা নিজেদের বিরুদ্ধে, তোমাদের সন্তান-সন্তুতির এবং তোমাদের সম্পদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করো না। কেননা, তোমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন মুহূর্তের জ্ঞানপ্রাপ্ত নও, যখন যা কিছুই চাওয়া হয় তিনি তোমাদের তা দিয়ে দেবেন।’’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৭৭০৫)
হাদীসটির ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী (রহ.) বলেন, অর্থাৎ তোমরা কোনো মুহূর্তেই নিজের বিরুদ্ধে, নিজের সন্তান বা সম্পদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করো না। কারণ, হতে পারে যে সময় তুমি দোয়া করছো, তা দিনের মধ্যে ওই সময় যখন যা-ই দোয়া করা হোক না কেন তা কবুল করা হয়। তোমরা তো এ সময় সম্পর্কে আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞানপ্রাপ্ত নও। (মিরআতুল মাফাতীহ ৭/৭০৩)
সুতরাং আপনার মাকে এভাবেও বুঝাতে পারেন যে, ‘মা! নিজের সন্তানের বিরুদ্ধে বদদোয়া করার অর্থ তো নিজেই নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া। কেননা, আপনার রাগের মাথায় উচ্চারণ করা কথাগুলো যদি সত্যে পরিণত তাহলে কেমন লাগবে? আপনি কি আপনার সন্তানের কষ্ট সহ্য করত পারবেন?’
উপরোল্লিখিত পদ্ধতিতে আপনি আপনার মাকে বুঝানোর চেষ্টা করবেন। এতে তিনি সন্তানের মনোবেদনা কিছুটা হলেও অনুধাবন করবেন বলে আশা করা যায়।
আল্লাহ তা‘আলাই সবচেয়ে ভালো জানেন।
و الله تعالى أعلم بالصواب
وصلى الله تعالى على رسوله وعلى آله وسلم
উত্তর দিচ্ছেন:
ড. মুফতি মুহাম্মাদ খলিলুর রহমান মাদানী
সূত্র:https://www.drkhalilurrahman.com/?p=29581&preview=true